Wednesday, 7 July 2010

বিশ্বকাপ ইতিহাস



বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা হচ্ছে ফুটবল। জনপ্রিয় খেলা, সুন্দরতম খেলা, আর বিশ্বকাপ হলো এই খেলার অলঙ্কার- ‘দ্য গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ।’ বিশ্বকাপ না হলে এই ফুটবলের উন্মাদনাই টের পাওয়া যেত না। তবে খুব সহজে এই বিশ্বকাপ আজকের অবস্থানে আসেনি। এজন্য পার হতে হয়েছে অনেক চড়াই-উতরাই। প্রথমদিকে শুধু শখের বসেই এই খেলাটি খেলা হতো, যা আন্তর্জাতিক রূপ ধারণ করে ১৮৭২ সালে। গ্লাসকোতে স্কটল্যান্ড ও ইংল্যান্ডের মধ্যকার ম্যাচটিই ছিল প্রথম আন্তর্জাতিক ম্যাচ। 

একটা সময় ফুটবলের গন্ডি ছিল শুধুই অলিম্পিক। তবে এর  জনপ্রিয়তা দিন দিন এভাবে বাড়তে থাকলো যে ফুটবল সংস্থা অলিম্পিকের বাইরেও একটি টুর্নামেন্ট আয়োজনের কথা চিন্তা করে। সেই লক্ষ্যে ১৯০৬ সালে সুইজারল্যান্ডে আয়োজন করা হয় একটি প্রতিযোগিতার। তবে আন্তর্জাতিক ফুটবলের বয়স খুব কম বলে ফিফা সেই প্রতিযোগিতাকে ব্যর্থ বলে ঘোষণা দেয়। 

তার দুবছর পরই ১৯০৮ সালে লন্ডনে, গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিকে ফুটবল প্রতিযোগিতা আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করে। ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন এফএ ছিল এর প্রধান পৃষ্ঠপোষক। তবে এই প্রতিযোগিতা আয়োজন করা হয় শুধুমাত্র অপেশাদার ফুটবলারদের জন্য। যেখানে গ্রেট ব্রিটেন স্বর্ণ পদক পায়। ঠিক এক বছর পরই ১৯০৯ সালে, স্যার থমাস লিপটন তুরিনে ‘স্যার থমাস লিপটন ট্রফি’ প্রতিযোগিতার আয়োজন করেন। সেখানে কোনো জাতীয় দল অংশগ্রহণ না করলেও বিভিন্ন দেশের কাবগুলো তাদের নিজ নিজ দেশের প্রতিনিধিত্ব করে। এজন্য এই প্রতিযোগিতাকে অনেকেই প্রথম বিশ্বকাপ বলে থাকেন। আর এতে অংশগ্রহণ করে ইতালি, জার্মানি, সুইজারল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশের খ্যাতনামা পেশাদার দল।

প্রথমে রাজি না হলেও ১৯১৪ সালে ফিফা, অলিম্পিক প্রতিযোগিতায় ফুটবলকে ‘অপেশাদার বিশ্ব ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপ’ হিসেবে স্বীকৃতি দিতে রাজি হয় এবং এই প্রতিযোগিতা পরিচালনার দায়িত্ব তারা নিজেরাই নেয়। এটাই দ্বার খুলে দেয় বিশ্বের প্রথম আন্তঃমহাদেশীয় ফুটবল প্রতিযোগিতা আয়োজনের। যেটা অনুষ্ঠিত হয় ১৯২০ সালের গ্রীষ্ম অলিম্পিকে। এতে অংশ নেয় মিসর ও ১৩টি ইউরোপিয়ান দল। এরপর ১৯২৪ সাল থেকে ফিফা পেশাদার ফুটবল খেলা শুরু করে।

১৯২৮ সালে ফিফা, অলিম্পিকের বাইরে আলাদাভাবে একটি বিশ্বকাপ আয়োজনের সিদ্ধান্ত নেয়। ইতালি, সুইডেন, নেদারল্যান্ডস, স্পেন ও উরুগুয়ে এই বিশ্বকাপ আয়োজনের ইচ্ছা প্রকাশ করে। তবে ফিফা ১৯২৯ সালে বার্সেলোনায়- একটি সেমিনারে উরুগুয়েকে বিশ্বকাপ আয়োজনের দায়িত্ব দেয়। কেননা সে বছর উরুগুয়ে স্বাধীনতার শতবর্ষে পা দিয়েছিল এবং তারা সফলভাবে ১৯২৮ গ্রীষ্ম অলিম্পিকের আয়োজন করে। 
১৯৩০ সালে ‘ফিফা বিশ্বকাপ’ ছিল প্রথম অনুষ্ঠিত কোনো ফুটবল বিশ্বকাপ। এবং এটাই একমাত্র বিশ্বকাপ যেখানে কোনো বাছাইপর্ব ছিল না। ফিফা তার সহযোগী সব দেশকেই অংশগ্রহণের জন্য আহ্বান জানায়। ১৯৩০ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি আমন্ত্রণ গ্রহণের শেষ দিন ধার্য করা হয়। ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, পেরু, প্যারাগুয়ে, চিলি, বলিভিয়া, যুক্তরাষ্ট্র ও মেঙিকো এতে অংশগ্রহণ করে। তবে বাকি ইউরোপীয় দলগুলো প্রতিযোগিতার প্রতি আকৃষ্ট হয়নি। কারণ উরুগুয়ে যেতে হলে আটলান্টিক মহাসাগর পাড়ি দিয়ে যেতে হতো, যা ছিল দীর্ঘ ও ব্যয়বহুল। যদিও উরুগুয়ের ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন ইংল্যান্ডের ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনকেও অংশগ্রহণের আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। ১৯২৯ সালের ১৮ নভেম্বর ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন কমিটি সেই প্রস্তাব নাকচ করে দেয়, প্রতিযোগিতা শুরুর দুমাস আগ পর্যন্ত ইউরোপের কোনো দেশই আনুষ্ঠানিকভাবে অংশগ্রহণের ঘোষণা দেয়নি। অবশেষে ফিফা প্রেসিডেন্ট জুলে রিমে ও উরুগুয়ের সরকার শেষ চেষ্টা হিসেবে অংশগ্রহণের বিনিময়ে ইউরোপীয় দলগুলোকে যাবতীয় ব্যয়ভার বহনের প্রস্তাব দেয়। শেষ পর্যন্ত তেরটি দল প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে। এর মধ্যে আমেরিকা অঞ্চলের ৯টি এবং ইউরোপের ৪টি। 

১৯৩০ সালে বেলজিয়াম, ফ্রান্স, রোমানিয়া ও যুগোস্লাভিয়া দলের খেলোয়াড়রা জাহাজে করে রওনা দেন। একই জাহাজে জুলে রিমে ট্রফিসহ তিনজন ইউরোপীয় রেফারিকেও নেয়া হয়।

১৯৩০ সালের ২৯ জুন রিউ দি জানেইরু থেকে ব্রাজিল দলকে নৌকাতে ওঠানো হয় এবং তারা ১৯৩০ সালের ৪ জুলাই উরুগুয়েতে পৌঁছায়। মার্সেই থেকে যুগোস্লাভিয়া দল বাষ্পীয় জাহাজ ফোরিডাতে করে উরুগুয়েতে পৌঁছায়। তাদের সঙ্গে অলিম্পিকের জায়ান্ট কিলার মিসর, দলের সাথে আসার কথা থাকলেও জাহাজ ধরতে পারেনি। ফলে  আটটি দলই অংশগ্রহণ করে।

বিশ্বকাপের প্রথম দুটি ম্যাচ একই সময়ে ফ্রান্স ও মেঙিকোর মধ্যে অনুষ্ঠিত হয়, যাতে ৪-১ গোলে ফ্রান্স জয়ী হয়। অন্য খেলায় যুক্তরাষ্ট্র বেলজিয়ামকে ৩-০ গোলে পরাজিত করে। 

বিশ্বকাপের প্রথম গোল করেন ফ্রান্সের লুসিয়েন লরেন্ত। ফাইনালে ওঠে প্রতিযোগিতার ফেভারিট উরুগুয়ে ও আর্জেন্টিনা এবং ৯৩,০০০ দর্শকের সামনে উরুগুয়ে আর্জেন্টিনাকে ৪-২ গোলে পরাজিত করে প্রথম বিশ্বকাপ শিরোপা লাভের গৌরব অর্জন করে। জুলাই ১৩ থেকে জুলাই ৩০ পর্যন্ত এই প্রতিযোগিতা উরুগুয়েতে অনুষ্ঠিত হয়।

প্রথম বিশ্বকাপের কথা

তেরটি দলকে চারটি গ্রুপে ভাগ করা হয়। ৪টি গ্রুপে রাখা হয় উরুগুয়ে, আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল ও যুক্তরাষ্ট্রকে। সব খেলা অনুষ্ঠিত হয় উরুগুয়ের রাজধানী মোন্তেবিদেওতে। উদ্বোধনী দিনে দুটি খেলা অনুষ্ঠিত হয়। প্রথম খেলায় ফ্রান্স মেঙিকোকে ৪-১ গোলে এবং দ্বিতীয় খেলায় যুক্তরাষ্ট্র বেলজিয়ামকে ৩-০ গোলে পরাস্ত করে। মেঙিকোর বিরুদ্ধে ফ্রান্সের লুসিয়েনের দেয়া গোলটিই ছিল বিশ্বকাপের প্রথম গোল।
গ্রুপ ১-এ ছিল আর্জেন্টিনা, চিলি, ফ্রান্স ও মেঙিকো। প্রথম খেলায় ফ্রান্স মেঙিকোর বিরুদ্ধে জয়লাভ করে। দ্বিতীয় খেলায় আর্জেন্টিনার সঙ্গে হেরে যায় ১-০ গোলে। সেই খেলাকে কেন্দ্র একটি বিতর্কের জন্ম নিয়েছিল। রেফারি আলমেদিয়া রেগো ভুল করে ছয় মিনিট বাকি থাকতেই খেলা শেষের বাঁশি বাজিয়ে দেন। পরে ফরাসি খেলোয়াড়দের চাপের মুখে খেলা আবার চালু হয়। আর্জেন্টিনা তাদের দ্বিতীয় খেলায় মেঙিকোর বিপক্ষে ৬-৩ গোলে জয়লাভ করে। এই খেলায় মোট পাঁচটি পেনাল্টি হয়। যার তিনটিই ছিল বিতর্কিত। আর্জেন্টিনা ও চিলির মধ্যকার ম্যাচটিতে আর্জেন্টিনা ৩-১ গোলে জেতে। তবে খেলার মাঝখানে দুদলের মধ্যে বাদানুবাদ হয় যখন মন্টি আর্টারো, টোরেসকে ফাউল করেন। তবে শেষ পর্যন্ত আর্জেন্টিনা ৩-১ গোলে জিতে সেমিফাইনালে ওঠে।

দ্বিতীয় গ্রুপে ছিল ব্রাজিল, বলিভিয়া ও যুগোশ্লাভিয়া। অভ্যন্তরীণ কলহের কারণে ব্রাজিল মূলত রিউ দি জানেইরু থেকেই তাদের খেলোয়াড়দের এই প্রতিযোগিতা পাঠিয়েছিল। গ্রুপের উদ্বোধনী খেলায় তারা ২-১ ব্যবধানে যুগোশ্লাভিয়াকে হারিয়ে দেয়। উভয় দলই স্বাচ্ছন্দ্যে বলিভিয়াকে হারায়। তবে ব্রাজিল ও বলিভিয়ার মধ্যকার খেলায় উভয় দলের পোশাকের রঙ প্রায় একই থাকায় অনেক সমস্যা দেখা দিয়েছিল। পরে মধ্যবিরতিতে বলিভিয়া তাদের পোশাক পরিবর্তন করে। যুগোশ্লাভিয়া সেমিফাইনালে উত্তীর্ণ হয়   
গ্রুপ ৩-এ ছিল আয়োজক উরুগুয়ে, পেরু ও রোমানিয়া। উদ্বোধনী খেলায় পেরু ও রোমানিয়া মুখোমুখি হয়। এই খেলাতেই প্রতিযোগিতার প্রথম লালকার্ড দেখানো হয়। লালকার্ড দেখেন পেরুর প্লাসিদো গালিন্দো। রোমানিয়া এই খেলায় শেষের দিকে ২ গোল করে ৩-১ ব্যবধানে বিজয়ী হয়। পরের খেলায় পেরুর বিপক্ষে উরুগুয়ে ১-০ ব্যবধানে জেতে। সেমিফাইনালে যাওয়ার পথে উরুগুয়ে রোমানিয়ার বিপক্ষে জেতে ৪-০ গোলে।

চতুর্থ গ্রুপে ছিল যুক্তরাষ্ট্র, বেলজিয়াম ও প্যারাগুয়ে । যুক্তরাষ্ট্রের দলটিতে ছিল প্রাক্তন পেশাদার ব্রিটিশ ফুটবলার ও অভিবাসী খেলোয়াড়। প্রথম খেলায় যুক্তরাষ্ট্র  বেলজিয়ামের বিপক্ষে ৩-০ গোলে জেতে। গ্রুপে দ্বিতীয় ম্যাচে যুক্তরাষ্ট্র বার্ট প্যাটেন্ডের হ্যাটট্রিকে প্যারাগুয়ের বিপক্ষে জয়লাভ করে। এই হ্যাটট্রিকই ছিল বিশ্বকাপের প্রথম হ্যাটট্রিক। প্রথম সেমিফাইনালে মুখোমুখি হয় আর্জেন্টিনা ও যুক্তরাষ্ট্র। প্রথমার্ধে মন্টির গোলে আর্জেন্টিনা ১-০ গোলে এগিয়ে যায়। তবে দ্বিতীয়ার্ধে যুক্তরাষ্ট্রকে দাঁড়াতেই দেয়নি আর্জেন্টিনা। অবশেষে ৬-১ গোলে জয় নিয়ে মাঠ ছাড়ে তারা। দ্বিতীয় সেমিফাইনালে মুখোমুখি হয় যুগোশ্লাভিয়া ও উরুগুয়ে। যুগোশ্লাভিয়া প্রথমে গোল করে এগিয়ে গেলেও পেদ্রো সির হ্যাটট্রিকে যুক্তরাষ্ট্র যুগোশ্লাভিয়ার বিপক্ষে ৬-১ গোলে জেতে।

১৯২৮ সালের অলিম্পিকের ফাইনালের মতো এই বিশ্বকাপের ফাইনালেও ওঠে আর্জেন্টিনা ও উরুগুয়ে। এস্তাদিও সেন্তেনারিওতে ফাইনাল খেলা অনুষ্ঠিত হয় জুলাইয়ের ৩০ তারিখে। খেলা শুরুর ৬ ঘণ্টা আগে স্টেডিয়াম খুলে দেয়া হয়। দুপুরের আগেই স্টেডিয়াম পূর্ণ হয়ে যায়। প্রায় ৯৩,০০০ দর্শক স্টেডিয়ামে খেলা দেখতে আসে। খেলা শুরুর পূর্বেই কার বল দিয়ে খেলা হবে সে বিষয়ে ঝগড়া বেধে যায়। শেষ পর্যন্ত ফিফা সিদ্ধান্ত নেয় প্রথমার্ধে আর্জেন্টিনার বল ও দ্বিতীয়ার্ধে উরুগুয়ের বল দিয়ে খেলা হবে। প্রথমার্ধে উরুগুয়ে ২-১ ব্যবধানে পিছিয়ে থাকলেও শেষ পর্যন্ত ৪-২ গোলে ম্যাচ জেতে এবং প্রথম বিশ্বকাপ বিজয়ী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। জুলে রিমে ‘বিশ্বকাপ ট্রফি’ প্রদান করেন। পরে তার নামানুসারেই এই ট্রফির নাম রাখা হয় ‘জুলে রিমে ট্রফি’।  



Your Ad Here. Click here to view your add.

No comments:

Post a Comment