Tuesday, 31 August 2010

উইকিলিকসের খ্যাপা সাংবাদিক

উইকিলিকসের প্রতিষ্ঠাতা জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জের চেয়ারটা নরম চামড়ায় তৈরি। ব্যাপারটা তাঁর পছন্দ নয়। কারণ রাগ বা জেদ প্রকাশের জন্য জোরে ঘুষি মারার মতো যথেষ্ট শক্ত নয় এর হাতলটা। কীভাবে তাঁর ওয়েবসাইট আফগান যুদ্ধের ৯০ হাজারেরও বেশি গোপন প্রতিবেদন প্রকাশ করতে পারল সে কাহিনি বলার জন্য চেয়ারে বসতে বসতে টাইম সাময়িকীর সাংবাদিককে কথাটা জানালেন অ্যাসাঞ্জ। ‘আমি চাই দড়াম করে একটা ঘুষি মেরে বলব, “শালার বাস্টার্ড সব! সবগুলোকে গুঁড়িয়ে দেব”!’


হাসিমুখে কথাটা বললেও অ্যাসাঞ্জের হাবভাব দেখে বোঝা মুশকিল, তিনি রসিকতা করছেন কি না। দীর্ঘদেহী, কিছুটা ম্রিয়মাণ, শুভ্রকেশধারী অ্যাসাঞ্জের গলার স্বর খুবই মৃদু। এতটাই যে মাঝেমধ্যে তাঁর কথা শোনাই মুশকিল। অথচ এর মাত্র এক দিন আগে এই ব্যক্তি তাঁর ওয়েবসাইটে আফগান যুদ্ধের গোপন কাগজগুলো প্রকাশ করে হইচই ফেলে দিয়েছেন।


আর কোনো বিষয়ই ক্ষমতাধর ব্যক্তিদের বিব্রত করার মতো আনন্দ দিতে পারে না অ্যাসাঞ্জকে। গোপন নথি প্রকাশ করতে সবাইকে সহায়তা করার জন্য ২০০৬ সালে উইকিলিকস প্রতিষ্ঠা করেন তিনি। নাম না প্রকাশের শর্তে যে কেউ সেখানে সরকার বা বড় প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে তথ্য ফাঁস করে দিতে পারে।


উইকিলিকসে সম্প্রতি তুলে ধরা হয়েছে আফগান যুদ্ধের ছয় বছরের বিস্তারিত বর্ণনা। বেসামরিক লোকজনের হতাহত হওয়া ও পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই এবং তালেবানের সম্ভাব্য আঁতাত-সম্পর্কিত নানা প্রতিবেদনসহ বহু নথিপত্র প্রকাশ করা হয়েছে ওয়েবসাইটটিতে। আফগান যুদ্ধের এই দলিলপত্র এখন পর্যন্ত উইকিলিকসের সবচেয়ে বড় স্কুপ।


নিজেকে একাধারে সাংবাদিক, প্রকাশক ও উদ্ভাবক মনে করেন অ্যাসাঞ্জ। তিনি বলেন, ‘আমি এমন একটি পদ্ধতি উদ্ভাবনের চেষ্টা করছি যা গণমাধ্যমের ওপর সেনসরশিপ সমস্যার সমাধান করবে।’


উইকিলিকসে কাজ করেন ছয়জন পূর্ণকালীন স্বেচ্ছাসেবী। ওয়েবসাইটটির রয়েছে প্রায় এক হাজার এনক্রিপশন বিশেষজ্ঞ। সাইটটির প্রধান সার্ভার সুইডেনে। তবে তারা কাজ করে বিশ্বজুড়ে। গত কয়েক বছরে অনেক গুরুত্বপূর্ণ নথি প্রকাশ করা হয়েছে ওয়েবসাইটটিতে। এর মধ্যে রয়েছে গুয়ানতানামো বে-র ক্যাম্প ডেলটায় বন্দীদের ওপর যে বিধিনিষেধ তার ম্যানুয়াল ও লন্ডনভিত্তিক কোম্পানি ট্রাফিগুরার একটি অভ্যন্তরীণ প্রতিবেদন। ট্রাফিগুরার ওই প্রতিবেদনে আফ্রিকার উপকূলে সম্ভাব্য বিষাক্ত দ্রব্য ফেলে আসার বিষয়ে বিস্তারিত বর্ণনা রয়েছে। এ ছাড়া ২০০৭ সালে ইরাকের রাজধানী বাগদাদে মার্কিন বাহিনীর হেলিকপ্টার থেকে চালানো হামলায় বার্তা সংস্থা রয়টার্স-এর দুই সাংবাদিকের নিহত হওয়ার ভিডিওচিত্র প্রকাশ করা হয়।


কেনিয়ার দুর্নীতিসংক্রান্ত নথিপত্র প্রকাশ করে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের পুরস্কার জিতেছে উইকিলিকস।


অ্যাসাঞ্জ বলেন, ক্ষতিগ্রস্তদের রক্ষা করার তাড়নাই তাঁর প্রেরণা হিসেবে কাজ করে। তাঁর ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, ‘সরকারের স্বচ্ছতা দুর্নীতি হ্রাস করে।’ যেসব সরকার তথ্য গোপন করে তাদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে পছন্দ করেন তিনি। অ্যাসাঞ্জ বলেন, তিনি ‘বুদ্ধিবৃত্তিক লড়াই’ পছন্দ করেন।


তবে অ্যাসাঞ্জ আসলেই কতটা সাংবাদিকতা করছেন, তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। ক্রমবর্ধমান সুখ্যাতি ও কুখ্যাতি সত্ত্বেও উইকিলিকসের মুখপাত্র শুধু তিনি নিজে। আর যাঁরা কাজ করছেন তাঁদের দায়বদ্ধতার বিষয়টি স্পষ্ট নয়। ওয়েবসাইটটিতে যেসব নথিপত্র প্রকাশ করা হয়, তা সব সময় হুবহু প্রকাশ করা হয় না। ২০০৭ সালে বাগদাদে মার্কিন হেলিকপ্টার হামলায় প্রাণহানির যে ভিডিওচিত্র প্রকাশ করা হয়েছিল তা ছিল কিছুটা সম্পাদিত। ওই ভিডিওচিত্রটি সমালোচনার মুখে পড়েছিল। কারণ, হেলিকপ্টার থেকে যাদের ওপর হামলা চালানো হয় তাদের একজনের হাতে ছিল রকেটচালিত গ্রেনেড লঞ্চার। উইকিলিকসে প্রকাশিত চিত্রে ওই লোকের ছবি বাদ দেওয়া হয়।


অনেকেই অ্যাসাঞ্জের কাজের পদ্ধতি নিয়ে উদ্বিগ্ন। রিপোর্টার্স কমিটি ফর ফ্রিডম অব দ্য প্রেসের নির্বাহী পরিচালক লুসি ডালগ্লিশ বলেন, ‘এটা সাংবাদিকতা নয়, এটা হচ্ছে তথ্য বিতরণ। এতে আমি উদ্বিগ্ন।’ তিনি আরও বলেন, কোনো স্পর্শকাতর তথ্য প্রকাশ করার আগে সাংবাদিকেরা ব্যাপক আলাপ-আলোচনার মধ্য দিয়ে যান। যদিও উইকিলিকস বলছে, তারাও একই কাজ করছে।


নাগরিকত্বে অস্ট্রেলিয়ান ৩৯ বছর বয়সী অ্যাসাঞ্জ ঘুরেফিরে চারটি জায়গায় থাকেন। নিরাপত্তাজনিত উদ্বেগের কথা উল্লেখ করে জায়গাগুলোর নাম নির্দিষ্ট করে জানাননি তিনি। ইউনিভার্সিটি অব মেলবোর্নে পদার্থবিজ্ঞানে পড়াশোনা করেছেন অ্যাসাঞ্জ। তরুণতর বয়সে তিনি ছিলেন হ্যাকার।


১৯৯১ সালে ২০ বছর বয়সে কানাডিয়ান টেলিকম কোম্পানি নরটেলের মাস্টার টার্মিনাল হ্যাক করেন অ্যাসাঞ্জ। এ ঘটনার পর তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। ২৬টি অভিযোগ স্বীকার করে নেন অ্যাসাঞ্জ। আরও ছয়টি অভিযোগ প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়। বিচারক অ্যাসাঞ্জের ‘বুদ্ধিদীপ্ত কৌতূহলের’ প্রশংসা করেন। শেষ পর্যন্ত তাঁকে সামান্য জরিমানা করা হয়।


সেই হ্যাকারের স্বভাব একেবারে ত্যাগ করেননি অ্যাসাঞ্জ। গোপন আস্তানা থেকে কাজ করেন। তিনি নিশ্চিত সরকারি গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর নজরদারির মধ্যে রয়েছেন। ভ্রমণের সময় তাঁর পেছনে নাকি গোয়েন্দা লেগে থাকে।


আফগানিস্তান-সংক্রান্ত তথ্য ফাঁস করার যুক্তি তুলে ধরে অ্যাসাঞ্জ বলেন, অন্যের সঙ্গে তথ্য আদান-প্রদানের অধিকার প্রত্যেকেরই রয়েছে। তিনি আরও বলেন, মার্কিন সংবিধানের প্রথম সংশোধনী এ বিষয়টি পরিষ্কার করেছে যে যা ঘটছে জনগণের সামনে তা তুলে ধরার অধিকার রয়েছে প্রকাশকদের।

সূত্র : টাইম
আরিফ মোহাম্মদ তারিক হাবিব

তারিখ: ২৭-০৮-২০১০
Prothom-alo

No comments:

Post a Comment