ধূলিকণার মতো এক কণা বীজ থেকে কী করে কয়েক বিঘা জমি ছেয়ে ফেলা বটগাছের জন্ম হয়, প্রাচীনকালের মানুষের কাছে তা ছিল রীতিমতো এক বিরাট রহস্য ও বিস্ময়কর। তাই পৃথিবীর অনেক দেশেই বট তথা বনস্পতি ছিল সৃষ্টিকর্তার একখণ্ড বিশ্বরূপ। এ দেশে এখনো পল্লি অঞ্চলে হিন্দু ও বৌদ্ধ সমপ্রদায়ের কাছে বট, পাকুড়, অশ্বত্থ অত্যন্ত পবিত্র গাছ। অশ্বত্থগাছের নিচে বসে গৌতম বুদ্ধ ধ্যান করে নির্বাণ লাভ করেছিলেন। তাই বৌদ্ধ সমপ্রদায় সে গাছটির নাম দিয়েছে বোধিবৃক্ষ। বোধিবৃক্ষই রূপক অর্থে ভগবান বুদ্ধের প্রতিকৃতি। শ্রীলঙ্কার অনুরাধাপুরের শ্রী মহা বোধিবৃক্ষ এক বিশ্বখ্যাত দেব অশ্বত্থগাছ।
এ দেশের প্রায় প্রতিটি গ্রামে এখনো একটা করে বট বা অশ্বত্থগাছ আছে, যার নিচে পূজা করা হয়। সেসব স্থানকে স্থানীয় ভাষায় ‘থান’ বা ‘ঠাকুরতলা’ বলে। সেটাকে লোকেরা গাছতলাও বলে। বট বা অশ্বত্থগাছই যেন ওদের কাছে গ্রামদেবতা, যে গ্রামের মানুষের সব বিপদ-আপদ থেকে রক্ষা করে। ঠাকুরগাঁও-দিনাজপুর এলাকায় এখনো অনেক গ্রামে বট ও অশ্বত্থগাছের বিয়ে দেওয়া হয়। সে বিয়ে উপলক্ষে কোথাও কোথাও বিয়ের অনুষ্ঠানের মতোই সব আয়োজন ও খাওয়াদাওয়া হয়। বিয়ের পর চারা দুটোকে একসঙ্গে বেঁধে কোনো মাঠের মধ্যে বা ফাঁকা জায়গায় লাগিয়ে দেওয়া হয়। সেখানেই গড়ে ওঠে দেবতার থান। এ নিয়ে স্থানীয় অধিবাসীদের মধ্যে অনেক পৌরাণিক কাহিনিও চালু আছে।
কোনো আদিবাসীদের মধ্যেও গাছ উপাসনার চল রয়েছে। সাঁওতালদের কারাম পূজায় শালগাছের ব্যবহার এর অন্যতম উদাহরণ। বিভিন্ন গ্রামে আগে গ্রামদেবতার পূজা হতো। গ্রামকে তারা কোনো না কোনো দেবতার অধীন বলে মনে করে। সেই দেবতার আসলে নির্দিষ্ট কোনো নাম থাকে না। সব বর্ণের লোকেরাই বিপদে সেই গ্রামদেবতার সাহায্য প্রার্থনা করে। সেই দেবতার উদ্দেশে বছরের একটা নির্দিষ্ট সময়ে পান, তামা, চাল, কলা, পানি ইত্যাদি দিয়ে নৈবেদ্য দেওয়া হয়। গ্রামদেবতার কোনো মূর্তি নেই, কোনো মন্দিরও নেই। গ্রামের মধ্যে কোনো এক গাছতলায় মাটির ঢিবি বা শানের বেদি তৈরি করে সেখানে নিম্নবর্ণের কোনো যাজক দিয়ে পূজা করানো হয়। সাধারণ মানুষ কখনো সে পূজা ছাড়তে পারেনি। কোন অঞ্চলের কোন গাছকে গ্রামদেবতার আশ্রয় বা থান হিসেবে বেছে নেওয়া হবে, তা অনেকটাই নির্ভর করে সে এলাকার বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য কোনো গাছকে। এখনো হাওরাঞ্চলে বিশেষ করে, সুনামগঞ্জে করচগাছের ঝোপে এ ধরনের থান ও পূজার প্রচলন দেখা যায়। করচগাছ হাওরের জলে মাসের পর মাস ডুবে থেকেও বেঁচে থাকে। এ গাছ জলে একদিকে যেমন মাছকে আশ্রয় দেয়, তেমনি মাটির ক্ষয় রোধ করে, ঢেউয়ের বেগ কমায়। জল নেমে গেলে গাছ আবার পাতা ছেড়ে সতেজ হয়ে ওঠে। হাওরাঞ্চলে ওই করচগাছই যেন হাওরের গ্রামবাসীর রক্ষক, গ্রামের দেবতা। তাই নানা স্থানে গেলে করচগাছের ভেতর পূজার বেদি দেখা যায়।
এ দেশের দক্ষিণাঞ্চলে খুলনা জেলায় শেওড়াগাছে শরৎকালে ফুলের মালা পরানোর একটা গ্রাম্য রীতি আছে। এমনকি সে অঞ্চলে দুর্গাপূজার তালনবমী তিথিতে বারুইরা পানের বরজকে অপদেবতার কুদৃষ্টি থেকে রক্ষা করার জন্য পানের বরজে একটা কলার খোলে করে আতপ চাল, পাকা কলা ও ফুল দিয়ে সকালে নৈবেদ্য দেয়। এটাও এক রকমের গাছপূজা।
শুধু এ উপমহাদেশেই নয়, কোনো কোনো গাছ অন্য দেশেও দেবতা বা ঈশ্বরের মর্যাদা পেয়ে থাকে। বলা যায়, সেসব দেশে ওগুলো যেন দেবতাবৃক্ষ। লেবাননে সিডারগাছগুলো তেমনই এক দেববৃক্ষ। সেখানে চিরসবুজ সিডারগাছকে মনে করা হয় ঈশ্বর বা সৃষ্টিকর্তার গাছ। লেবাননের পাহাড়ে জন্মানো এসব গাছকে প্রাচীনকাল থেকেই দেববৃক্ষ হিসেবে বিবেচনা করা হয়ে আসছে। বাইবেলে অন্তত ৭০ জায়গায় লেবাননের এই সিডারগাছের উল্লেখ রয়েছে। সে জন্যই হয়তো লেবাননের কিছু সিডারগাছ হয়ে উঠেছে ঈশ্বর যিশুর প্রতিকৃতি। প্রাচীনকালে জেরুজালেমে প্রথম মন্দিরটাই তৈরি করা হয়েছিল এ গাছের কাঠ দিয়ে। একসময় লেবাননে এ গাছ ছিল প্রচুর, এখন অনেক কমে গেছে। বর্তমানে মাউন্ট ম্যাকমেলের উপত্যকায় কিছু গাছ টিকে আছে। ব্রিটেনের রানি ভিক্টোরিয়া ১৮৭৬ সালে ১০২ হেক্টর জমিতে সিডারগাছ লাগিয়ে সেগুলো দেয়াল দিয়ে ঘিরে দিয়েছিলেন। সেটি ১৯৯৮ সালে ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকায় স্থান পায়।
মৃত্যুঞ্জয় রায়
তারিখ: ৩০-০৭-২০১০
No comments:
Post a Comment