Tuesday, 21 September 2010

মশা দিয়ে মশা নিধন!!!

মশার অত্যাচারে বা মশার কামড়ে অতিষ্ঠ হয়নি বাংলাদেশে এমন লোক খুঁজে পাওয়া যাবে না। মশার কামড় বা অত্যাচার সহ্য করার পাশাপাশি মশার কামড়ে বিভিন্ন রোগ-ব্যাধিতে আক্রান্ত হওয়া আজ জনগণের একটি সাধারণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। ক্ষতিকর মশা নিধনে সম্প্র্রতি ‘টক্সোরিনকাইটিস স্প্লেন্ডেস’ (Toxorhynchites splendens) বা উপকারী মশা নামের এক জাতের মশা দ্বারা ক্ষতিকর মশা নিধনকল্পে গবেষণা চালিয়ে সফল হয়েছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইনস্টিটিউট অব বায়োলজিক্যাল সায়েন্সেসের (আইবিএসসি) গবেষক মোরশীদুল হাসান। ২০০৬ সালে তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক সোহরাব আলীর তত্ত্বাবধানে ‘টক্সোরিনকাইটিস স্প্লেন্ডেস অব বাংলাদেশ অ্যান্ড ইটস ইফিকেসি টু কন্ট্রোল আদার মসকিউটও’ (Toxorhynchites Splendens of Bangladesh and its efficacy to control other Mosquito) বিষয়ে অর্থাৎ উপকারী মশা দ্বারা ক্ষতিকর মশা নিয়ন্ত্রণ বিষয়ে গবেষণা শুরু করেন। উপকারী মশা ডেঙ্গুজ্বর ও গোদরোগের উৎস এডিস ও কিউলেক্স মশার লার্ভা খেয়ে ফেলে। ফলে মানুষকে ক্ষতি করে বা কামড়ায় এমন মশা আর জন্ম নিতে পারে না। তাই এ মশার নাম দেওয়া হয়েছে উপকারী মশা।
গবেষক মোরশীদুল হাসান জানান, দৈহিক আকৃতিতে উপকারী মশা ক্ষতিকর মশার চেয়ে কয়েক গুণ বড়, পূর্ণাঙ্গ স্ত্রী বা পুরুষ মশা প্রায় এক সেন্টিমিটার, ডিম সাদাটে। লার্ভা থেকে পিউপায় পরিণত হওয়ার সময় এরা কোনো খাবার গ্রহণ করে না। তিনি বলেন, লার্ভা অবস্থায় এরা থাকে মাংসাশী। এ অবস্থায় এরা ক্ষতিকর ও রোগ বহনকারী মশার লার্ভা খেয়ে ওই সব মশার বিস্তার রোধ করে। এ প্রজাতির মশা গাছের কোটর, কাটা বাঁশের কোটর, ডাবের খোসা, গাছের তিন ডালের সংযোগ, প্লাস্টিক ও মাটির পাত্রের জমা পানিতে ডিম পাড়ে। গবেষক মোরশীদুল হাসান জানান, শেরপুর অঞ্চল থেকে উপকারী মশা সংগ্রহ করে গবেষণাগারে এনে এদের লালন-পালন ও প্রজনন করা হচ্ছে। ডিম ফুটে লার্ভা বের হওয়ার পর ওটাকে ক্ষতিকর মশার লার্ভা খাদ্য হিসেবে দেওয়া হয়। পূর্ণাঙ্গ মশাগুলো মশারির খাঁচায় রেখে চক্রাকারে বংশ প্রজননের মাধ্যমে উপকারী মশার সংখ্যা বাড়ানো হচ্ছে বলে তিনি উল্লেখ করেন। উপকারী মশা লার্ভা অবস্থায় যেমন ক্ষতিকর মশার লার্ভা খেয়ে থাকে, তেমনি পূর্ণাঙ্গ মশাকেও ক্ষতিকর মশা নিধনে বিভিন্ন গবেষণার কাজে ব্যবহার করা যায়। একটি পূর্ণাঙ্গ উপকারী মশার আয়ু সাধারণত প্রায় চার মাস হয়ে থাকে বলে তিনি জানান।
টক্সোরিনকাইটিস স্প্লেন্ডেস স্ত্রী বা পুরুষ মশা মানুষ বা অন্য কোনো প্রাণীকে কামড়াতে পারে না। আবার স্ত্রী মশার ডিম বৃদ্ধির জন্য অন্যান্য ক্ষতিকর মশার মতো মানুষ বা অন্য কোনো প্রাণীর রক্ত শোষণেরও প্রয়োজন হয় না। এরা ফুলের মধু, ফলের বা কাণ্ডের রস ও অন্যান্য মশার লার্ভা খায়। গত বছর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রায় দুই হাজার এই উপকারী মশা ছাড়া হয়েছে। জানা গেছে, উপকারী মশা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএসসির গবেষণা মাঠের আশপাশের এলাকায় আনুষ্ঠানিকভাবে ছেড়ে দেওয়ার পর ওই এলাকায় ক্ষতিকর মশার উপদ্রব ক্যাম্পাসের অন্যান্য এলাকার ক্ষতিকর মশার উপদ্রব থেকে অনেকাংশে কমে এসেছে।
সম্প্র্রতি সরেজমিনে বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএসসির গবেষণা মাঠে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে মাটির বিভিন্ন বড় বড় পাত্রে, গাছের খোলে ও বিভিন্ন কোটরে রাখা আছে ক্ষতিকর মশার লার্ভা। আর সেসব পাত্র, খোল ও কোটরে উপকারী মশা ও উপকারী মশার লার্ভাও ছেড়ে দেওয়া আছে। ক্ষতিকর মশার লার্ভা তথা ক্ষতিকর মশা যদি একসময় শেষ হয়ে যায়, তখন এ উপকারী মশা কি খেয়ে বেঁচে থাকবে—এমন প্রশ্নের জবাবে গবেষক মোরশীদুল হাসান জানান, উপকারী মশার দ্বারা ক্ষতিকর মশা বা ক্ষতিকর মশার লার্ভা যদি একসময় শেষ হয়ে যায়, তবে উপকারী এ মশা মাছি বা অন্যান্য কীটপতঙ্গের লার্ভা বা গাছপালার পাতার রস খেয়ে বেঁচে থাকবে। উপকারী মশা নিয়ে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী—এ প্রশ্নের জবাবে গবেষক মোরশীদুল হাসান বলেন, ঢাকা শহরসহ দেশের যেসব জায়গায় মশার উপদ্রব বেশি, সেসব জায়গায় প্রচুর পরিমাণে এ মশা ছেড়ে দেওয়ার ইচ্ছা রয়েছে তাঁর। তিনি বলেন, গবেষণা শেষে অধিকমাত্রায় এ মশার প্রজনন ঘটিয়ে তথা বংশবৃদ্ধি ঘটিয়ে সারা দেশে এ জাতের মশা ছেড়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করতে পারলে দেশের আপামর জনগণ যেমন একদিকে ক্ষতিকর মশার কামড় বা অত্যাচার থেকে রক্ষা পাবে, তেমনি অন্যদিকে জনগণ ক্ষতিকর মশার কামড়জনিত রোগ যেমন ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়া, গোদ ইত্যাদি থেকেও সহজেই পরিত্রাণ পাবে। আর এ ব্যবস্থা কার্যকর করতে পারলেই তাঁর গবেষণার উদ্দেশ্য সার্থক হয়ে উঠবে বলে তিনি মনে করেন। ক্ষতিকর মশা নিধনের এই প্রক্রিয়াটি সারা দেশে ছড়িয়ে দিতে পারলে মশার উপদ্রব কিছুটা হলেও কমতে পারে।
 
কুদরাত-ই-খুদা 
তারিখ: ০৫-০৯-২০১০
Prothom-Alo 

No comments:

Post a Comment